সাম্প্রতিক কালে আমেরিকার হাজার হাজার পরিবার ছুটির দিন এসেছে কোভিড-১৯’এ প্রিয়জনদের হারিয়ে। ২০২০ সালেও কোভিড বা অন্যান্য কারণে বহু বিশিষ্ট আমেরিকান মারা গেছেন যারা পৃথিবীতে তাঁদের কীর্তি রেখে গেছেন।
নিউ ইয়র্ক সিটির প্রথম আফ্রো-আমেরিকান মেয়র ডেভিড ডিনকিনস ৯৩ বছর বয়সে মারা যান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে নতুন রূপে সাজিয়েছেন। চলে গেছেন হলিউডের স্বর্ণযুগের সর্বশেষ জীবিত দুই চলচ্চিত্র তারকা অভিনেতা কির্ক ডগলাস (বয়স ১০৩) ও অলিভিয়া ডি হ্যাভিল্যান্ড (১০৪) যারা বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্র পর্দায় রোমান্স ও নাটককে মূর্ত করে তুলেছিলেন। কোভিড-১৯’এ আরো যাদের হারিয়েছি তাদের অন্যতম হলেন কান্ট্রি মিউজিকের কিংবদন্তী ও নিজ ঘরানার সংগীতে বিখ্যাত প্রথম আফ্রো-আমেরিকান শিল্পী চার্লি প্রাইড (৮৬) এবং জীবন ও প্রেম বিষয়ক বিদ্রুপাত্মক রাই (wry) গীতিকাব্যের জন্য স্বীকৃত কান্ট্রি/লোক কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকার জন প্রাইন (৭৩)। সৌল ধারার গায়ক বিল উইদার্স (৮১)-এর মৃত্যু ছিলো বিশেষভাবে শোকের কেননা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে তাঁর লিন অন মি গানটি নিজ কণ্ঠে গেয়ে অনলাইনে প্রকাশ করে আসছিলো আমেরিকানরা।
এখানে রয়েছে ২০২০ সালে মৃত্যুবরণকারী আরো ১১ জন আমেরিকানের নাম যারা অনন্য সাধারণ জীবন যাপন করে গেছেন।
নাগরিক অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ জন লুইস ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটন পদযাত্রা সংগঠিত করতে সহায়তা করেন। ১৯৬৫ সালে আফ্রো-আমেরিকানদের ভোটাধিকারের দাবিতে তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা অ্যালাবামা’র এডমুন্ড পেটাস সেতু পার হয়। সেতুর শেষ প্রান্তে এলে সরকারী সৈন্যরা তাঁর ওপর আক্রমণ চালায়। তাদের সহিংসতা পুরো জাতিকে হতবাক করে দেয় এবং ১৯৬৫ সালের ভোটাধিকার আইনের পথ ত্বরান্বিত করে। জর্জিয়া থেকে নির্বাচিত যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্য হিসাবে ১৯৮৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কাজের মাধ্যমে লুইস “কংগ্রেসের বিবেক” হিসাবে সম্মান লাভ করেন। তিনি গত ১৭ জুলাই ৮০ বছর বয়সে মারা যান।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং লৈঙ্গিক সমতা ও নারী অধিকারের প্রবক্তা রুথ বেইডার গিন্সবার্গ ছিলেন আদালতে দায়িত্ব পালনকারী দ্বিতীয় নারী এবং প্রথম ইহুদি নারী। কলাম্বিয়া ল স্কুলে শীর্ষস্থান নিয়ে উত্তীর্ণ হবার পর ১৯৯৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে তাঁর কার্যকালে বহু মামলা প্রসঙ্গে জোর প্রতিবাদী লেখার কারণে তিনি উদারপন্থী শাখার নেতা হয়ে ওঠেন। লোকমুখে তিনি “কুখ্যাত আরবিজি” (একজন র্যাপ গায়কের ডাকনাম নিয়ে নাটক) আখ্যা পান যা তিনি মেনে নিয়েছিলেন তিনি গত ১৮ সেপ্টেম্বর ৮৭ বছর বয়সে মারা যান।
গিটারবাদক এডি ভ্যান হেইলেন (ভাই অ্যালেক্সের সাথে যৌথভাবে) রক সংগীতের ইতিহাসে সফলতম ব্যান্ডদল ভ্যান হেইলেন প্রতিষ্ঠা করেন। সাত বছর বয়সে তিনি তাঁর পরিবারের সাথে নেদারল্যান্ডস থেকে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে আসেন। গিটারে হাত পাকানোর আগে তিনি পিয়ানো শেখা শুরু করেন। মঞ্চে তাঁর আনন্দমুখর উপস্থিতির সাথে তিনি কারিগরি নৈপুণ্যের সংযোগ ঘটান। এর ফলে তিনি তাঁর প্রজন্মের সবচেয়ে প্রভাবসম্পন্ন গিটারবাদকের খ্যাতি অর্জন করেন এবং ২০০৭ সালে রক অ্যান্ড রোল হল অফ ফেইম-এ ভূষিত হন। ২০১২ সালে গিটার ওয়ার্ল্ড সাময়িকীতে তাঁকে সর্বকালের সেরা গিটারবাদক হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তিনি গত ৬ অক্টোবর ৬৫ বছর বয়সে মারা যান।
আণবিক জীববিজ্ঞানী ফ্লোসি অং-স্তাল ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এইচআইভি’র ক্লোন করেন ও এর জিনের কার্যক্রম শনাক্ত করেন যা ছিলো এইডস ঘটার পেছনে এইআইভি’র ভূমিকা প্রমাণের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ। তিনি এই ভাইরাসের উৎপত্তি বিষয়ক জেনেটিক ম্যাপিংও সম্পন্ন করেন যার ফলে এইচআইভি’র পরীক্ষা আবিষ্কৃত হয়। চীনে জন্ম নেয়া এবং হংকংয়ে বেড়ে ওঠা ফ্লোসি ১৮ বছর বয়সে অধ্যয়নের জন্য পাড়ি জমান লস এঞ্জেলেস’র ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি ব্যাকটেরিয়া বিদ্যা ও আণবিক জীববিদ্যা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর কাজ এইচআইভি/এইডস রোগীদের জন্য নতুন চিকিৎসা প্রবর্তনে অবদান রেখেছে এবং বর্তমানে কোভিড-১৯ মোকাবেলায়ও ব্যবহৃত হচ্ছে।
অভিনেতা চ্যাডউইক বোসম্যান ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী বক্স অফিস রেকর্ড সৃষ্টিকারী কালজয়ী সুপারহিরো মুভি ব্ল্যাক প্যান্থার-এ অভিনয় করেন। আফ্রিকার একটি কল্পিত দেশের রাজা টি’চালা চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ব্ল্যাক প্যান্থার মুভিতে তিনি শক্তি ও মর্যাদা ফুটিয়ে তোলেন। ২০২২ সালে মার্ভেল স্টুডিওস ব্ল্যাক প্যান্থারের একটি সিকুয়াল প্রকাশ করবে। তবে বোসম্যানের সম্মানার্থে তাঁর ভূমিকায় অন্য কাউকে নেয়া হবে না। পূর্বে তিনি বিভিন্ন যুগস্রষ্টা ব্যক্তির চরিত্রে রূপদান করেন যেমন 42 মুভিতে বেসবল খেলোয়াড় জ্যাকি রবিনসন হিসাবে এবং মার্শাল মুভিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থার্গুড মার্শাল হিসাবে। তিনি গত ২৮ আগস্ট মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মারা যান।
পরীক্ষামূলক বিমানের পাইলট বা টেস্ট পাইলট চাক ইয়েগার ১৯৪৭ সালে আনুভূমিক উড্ডয়নে প্রথম শব্দের গতি ছাড়িয়ে বিমান চালনা নিশ্চিত করেন। শব্দের গতিসীমা ছাড়ানোর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর চৌকস বিমান যোদ্ধা বা ফ্লাইং এইস যিনি এক পর্যায়ে একটি পৃথক মিশনে শত্রুপক্ষের পাঁচটি বিমান ভূপাতিত করেন। পরে তিনি বিমানের গতি ও উচ্চতা বিষয়ে কয়েকটি রেকর্ড গড়েন এবং তাঁর সফলতাগুলো মহাকাশ অনুসন্ধানের পথ প্রশস্ত করে। প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসাবে অবসর গ্রহণের পর তিনি টম উওলফে’র গ্রন্থ দি রাইট স্টাফ এবং একই নামের একটি মুভির মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করেন। তিনি গত ৭ ডিসেম্বর ৯৭ বছর বয়সে মারা যান।
কম্পিউটার শিল্পের গোড়ার দিকের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ফ্র্যান্সেস অ্যালেন ছিলেন তাঁর কর্মক্ষেত্রে হাতেগোনা কয়েকজন নারীর অন্যতম যিনি বিভিন্ন প্রাগ্রসর গবেষণা পরিচালনা করেছেন যেগুলো আজকের দিনের সুদক্ষ ও বিদ্যুৎঝলকের মতো দ্রুতগতির অ্যাপস ও কম্পিউটার, স্মার্টফোন এবং ওয়েবসাইটের বিভিন্ন সফটওয়ারের ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। মানুষের লেখা প্রোগ্রামকে কম্পিউটারের ভাষা তথা মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ “কোড”-এ রূপান্তরকারী সংকলন প্রযুক্তি (compiler technology) বিষয়ে তিনি কয়েক দশক ধরে যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। প্রথম নারী হিসাবে তিনি ২০০৬ সালে কম্পিউটিং ক্ষেত্রে নোবেল প্রাইজ হিসাবে পরিচিত এ.এম. টিউরিং পুরস্কার লাভ করেন। তিনি গত ৪ আগস্ট ৮৮ বছর বয়সে মারা যান।
লেখক ও অঙ্কনশিল্পী টমি ডি-পাওলা ২৭০টিরও বেশি শিশুতোষ বই লিখেছেন বা বইয়ের চিত্রাঙ্কন করেছেন যেগুলো কয়েক প্রজন্মকে বিনোদন দিয়েছে। বইগুলোর অন্যতম “স্ট্রেগা নোনা” সিরিজের প্রধান চরিত্র হলো ইতালির ক্যালাব্রিয়ার কোমলহৃদয় “ডাইনি ঠাকুরমা” যে স্থানীয় নগরবাসীকে সাহায্য করতে তার জাদু প্রয়োগ করে। এই সিরিজের প্রথম বইটি ১৯৭৬ সালে কোল্ডেকট অনার পুরস্কার অর্জন করে এবং ২০১২ সালে স্কুল লাইব্রেরি জার্নাল’র পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ভোটে সর্বকালের “সেরা ১০০ চিত্রাঙ্কিত বই”-এর অন্যতম হিসাবে নির্বাচিত হয়। শিশু সাহিত্যে অবদানের জন্য বহু সম্মানের অধিকারী ডি-পাওলা গত ৩০ মার্চ ৮৫ বছর বয়সে মারা যান।
আইনজীবী, বিনিয়োগ ব্যাঙ্কার ও অর্থনীতিবিদ জেমস উলফেনসন বিশ্ব ব্যাংক’র প্রেসিডেন্ট হিসাবে ১৯৯৫-২০০৫ কার্যকালে দারিদ্র্য বিমোচনে মনোনিবেশের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দরিদ্রদের রক্ষক হিসাবে পরিচিতি পান। তিনি উন্নয়ন অর্থায়ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির সমস্যা বিষয়ে আলোকপাত করেন এবং ব্যাংকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেন। অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণকারী উলফেনসন কয়েক বছর আগে ক্রিসলার কর্পোরেশনকে দেউলিয়াত্বের দোরগোড়া থেকে উদ্ধারে সহায়তা করেন। তিনি কেনেডি সেন্টার ও কার্নেগি হল’সহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কিছু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটান। গত ২৫ নভেম্বর ৮৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
রক ‘এন’ রোল সংগীতের পথিকৃৎ লিটল রিচার্ড ১৯৫০’র দশকে পবিত্র (গসপেল সংগীত) ও বিদ্রুপাত্মক (ব্লুজ) গানের মধ্যে একটি বিশিষ্ট রক ভঙ্গি চালু করেন। তিনি ছিলেন প্রথম মিশ্র ধারার কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীদের অন্যতম যার সংগীত সকল জাতিগোষ্ঠীর ভক্ত আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। জন্মকালে রিচার্ড পেনিম্যান নাম নেয়া রিচার্ড তাঁর সংগীত পরিবেশনায় এক ধরনের বেপরোয়া ও উদ্দাম শক্তির প্রকাশ ঘটান এবং সৌল ও ফাঙ্ক সংগীতের ধারা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখেন। তিনি জেমস ব্রাউন ও প্রিন্সসহ অসংখ্য শিল্পীর ওপর প্রভাব রেখেছেন এবং ১৯৮৬ সালে রক অ্যান্ড রোল হল অফ ফেইম-এ ভূষিত হন। তিনি গত ০৯ মে ৮৭ বছর বয়সে মারা যান।
বুলগেরিয়াতে জন্মগ্রহণকারী ধারণাশ্রয়ী শিল্পী (conceptual artist) ক্রিস্টো (পুরো নাম: ক্রিস্টো ভ্লাদিমিরভ জাভাশেফ) বিশ্বব্যাপী তাঁর বৃহদাকার, অস্থায়ী ও উন্মুক্ত স্থাপনার জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। শুধু নামের প্রথমাংশ ব্যবহারকারী এই শিল্পী প্যারিসের পন্ট নেউফ ও মায়ামি দ্বীপের বিসকেইন বে’সহ বিভিন্ন বিখ্যাত স্মৃতিসৌধ ও দর্শনীয় স্থানগুলোকে বাতাসে ফোলানো কাপড়ে সজ্জিত করতে কয়েক দশক অতিবাহিত করেছেন। ক্রিস্টোর কর্মকাণ্ডে শিল্পজগতে প্রায়শ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লেও তাঁর কাজ জনপ্রিয় ছিলো এবং তিনি নিশ্চিত করেছেন যে তাঁর সৃষ্ট সজ্জাগুলো (অধিকাংশই নিজ অর্থায়িত) জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। গত ৩১ মে ৮৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
এ নিবন্ধ রচনায় ভূমিকা রেখেছেন নিজস্ব লেখক লিনোর অ্যাডকিন্স।