কমিকসের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম জন লুইসকে চিনেছে

জন লুইস শিশুদের হাত ধরে মিলনায়তনের মধ্যে পদযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন (© কার্লোস গঞ্জালেজ/দি নিউ ইয়র্ক টাইমস)
প্রয়াত কংগ্রেসম্যান জন লুইস তাঁর খুদে ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে কমিক-কন ২০১৭-এ হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁর ডানদিকে পেছনে অঙ্কনশিল্পী নেইট পাওয়েল এবং বাঁদিকে সামনে সহ-লেখক অ্যান্ড্রু আইডিন। (© কার্লোস গঞ্জালেজ/দি নিউ ইয়র্ক টাইমস)

মহামারী থাকুক আর নাই থাকুক, এই সপ্তাহে আমেরিকানরা ঠিকই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে ১৯৬৩ সালের সেই বিখ্যাত চাকরি ও স্বাধীনতার জন্য ওয়াশিংটনমুখী পদযাত্রা, যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকার আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলন পূর্ণতা পেয়েছিল।

ওয়াশিংটনে ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট আনুমানিক আড়াই লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে আমেরিকানরা অনলাইনে ও ওয়াশিংটনসহ পুরো যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে দিনটিকে উদযাপন করবে।

এদিন অনেকেই কমিকসের মাধ্যমে লেখা গ্রাফিক উপন্যাস ত্রয়ী “মার্চ” (পদযাত্রা) পড়ে অনুপ্রাণিত হবেন, যার সহ-লেখক হলেন প্রয়াত কংগ্রেসম্যান জন লুইস এবং তার লেখাগুলো ২০১৩ থেকে ২০১৬ সময়কালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। এই ধারাবাহিকটি সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের জাতীয় তালিকায় স্থান করে নিয়েছে, এবং ত্রয়ী উপন্যাসের তৃতীয় বইটি ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড বিজয়ী।

সাদা-কালো শিল্পকর্মে দেখানো হয়েছে লিঙ্কন মেমোরিয়াল থেকে সমাবেশকে দেখছে, পেছনে ওয়াশিংটন স্মৃতিস্তম্ভ দেখা যাচ্ছে (মার্চ-এ নেট পাওয়েলের আঁকা ছবি © জন লুইস এবং অ্যান্ড্রু আইডিন, সৌজন্যে টপ শেলফ প্রোডাকশনস)
১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনমুখী পদযাত্রা (গ্রাফিক উপন্যাস মার্চ-এ অঙ্কন শিল্পী নেট পাওয়েলের আঁকা ছবি © জন লুইস এবং অ্যান্ড্রু আইডিন, সৌজন্যে টপ শেলফ প্রোডাকশনস)

জন লুইসের বয়স তখন মাত্র ২৩ বছর। তিনি সেদিন লিঙ্কন মেমোরিয়ালে বক্তৃতা দেয়া সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। ৫৭ বছর আগে আগস্টের এমন এক দিনে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সেই বিখ্যাত বক্তৃতা “আই হ্যাভ আ ড্রিম (আমার একটি স্বপ্ন আছে)” দেয়ার ঠিক আগের বক্তা ছিলেন জন লুইস।

শেয়ার-আমেরিকার  পক্ষ থেকে গ্রাফিক উপন্যাস “মার্চ”-এর সহ-লেখক অ্যান্ড্রু আইডিন ও অঙ্কন শিল্পী নেইট পাওয়েলের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল প্রয়াত কংগ্রেসম্যান জন লুইসের সাথে তাদের শৈল্পিক অংশীদারিত্ব সম্পর্কে জানতে।

শুরুটা হয়েছিল অনেক বছর আগে, যখন আইডিন কংগ্রেসম্যান লুইসের অফিসে একজন সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। সেসময়ে তিনি সহকর্মীদের কমিক বইয়ের লেখক, শিল্পী ও ভক্তদের বার্ষিক সম্মেলন কমিক-কন-এ অংশ নেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। সহকর্মীরা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে বরং উপহাস করেছিল। কিন্তু আইডিনের পরিকল্পনার কথা জেনে জন লু্ইস যখন বললেন যে, তিনি নিজেও ১৯৫৭ সালে মার্টিন লুথার কিংয়ের উপর লেখা কমিক বই পড়ে প্রভাবিত হয়ে নিজের চলার পথ বেছে নিয়েছিলেন; এবং একজন তরুণ নাগরিক অধিকার আন্দোলন কর্মী থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে দায়িত্ব পালন করছেন।

আইডিন তখন তার কমিক বইয়ের জন্য লুইসের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চান। কিন্তু ইতোমধ্যে লুইসের লেখা স্মৃতিচারণমূলক বই ওয়াকিং উইথ দ্য উইন্ড প্রকাশিত হয়েছে। তাই একই ধরনের কাহিনীভিত্তিক কমিক বই লেখার ব্যাপারে লুইসের দিক থেকে তেমন একটা সায় ছিলো না। আইডিন বলেন, “কংগ্রেসম্যান লুইসকে রাজী করানোর জন্য আমি তাঁকে বলেছিলাম যে, নতুন প্রজন্মের কাছে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের ইতিহাস পৌঁছানোর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে কমিক বই। একসময় তিনি রাজী হন, এবং রাজী হওয়ার পর পুরো বিষয়টিকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। ”

একটি আধুনিক সাহিত্য যেভাবে তৈরি হলো

আইডিনের মনে আছে, তিনি লুইসের সাক্ষাতকার নিতেন কাজের শেষে কিংবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে। এভাবেই সাক্ষাতকার নেওয়া, পাণ্ডুলিপি তৈরি করা এবং সেই পাণ্ডুলিপি কংগ্রেসম্যানকে দেখানো এবং তাঁর মতামত নিয়ে চূড়ান্ত করার কাজ চলছিল।

তিনজন মানুষ ছবি তোলার জন্য পোজ দিয়েছেন, তাদের পেছনে ব্রিজের কাঠামো দেখা যাচ্ছে (© সান্দি ভিলারিয়েল)
আলবামার সেলমা-তে এডমন্ড পেটাস ব্রিজের উপর সহ-লেখক লুইসের সঙ্গে বাঁয়ে পাওয়েল এবং ডানে আইডিন। (© সান্দি ভিলারিয়েল)

ত্রয়ী গ্রাফিক উপন্যাসের প্রতিটি খন্ড প্রকাশিত হওয়ার পর দুই লেখক ও অঙ্কন শিল্পী একত্রিতভাবে বক্তৃতা অনুষ্ঠানগুলোতে যেতেন। আইডিন বলেন, কখনো কখনো সেই সব অনুষ্ঠানে আগত শ্রোতার প্রশ্ন কিংবা অনুষ্ঠানের জন্য আমরা যে জায়গায় যেতাম সেখানে কিছু একটা দেখে লুইসের পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যেতো এবং তিনি তখন বলতেন ‘আমাদেরকে অবশ্যই এই বিষয়গুলোও (বইয়ে) থাকা নিশ্চিত করতে হবে।’

অঙ্কন শিল্পী পাওয়েল সেই সময়টাকে ফুঁটিয়ে তুলতে সাদা, কালো ও ধূসর রংয়ের বিভিন্ন শেড ব্যবহার করেছেন, আর নাগরিক অধিকারের সেই সময়টার ছবি সম্পর্কে ধারণা নিতে তিনি তখনকার টিভি সংবাদের ফুটেজ দেখেছেন। পাওয়েল বলেন, (তিনজনে মিলে) যৌথভাবে এই কাজ করার প্রক্রিয়াটি “খুবই নিবিড়” ছিলো, প্রতিটি পদক্ষেপেই ত্রিমুখী যোগাযোগ করার দরকার হয়েছিল।

পাওয়েল বলেন, নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময়কার ছবি খোঁজার সময় “অ্যান্ড্রুর পাণ্ডুলিপি থেকে পাওয়া তথ্য আমি সাধারণত অন্যান্য ঐতিহাসিক বর্ণনার সাথে মিলিয়ে নিতাম” এবং লুইসের প্রকাশিত স্মৃতিচারণমূলক বইয়ের সাথেও মিলাতাম। “পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল মন্ত্রমুগ্ধকর (বিষয়ের গভীরে ডুবে থাকতাম),” আর যখন আমরা তিনজন একসাথে কোথাও ভ্রমণে যেতাম সবকিছু আরো বিস্তারিত জানতে পারতাম, এমনটা প্রায়ই ঘটতো।

পাওয়েল এই কাজ করতে গিয়ে কখনো কখনো মুশকিলে পড়ে যেতেন, তার ভেবে পেতে কষ্ট হতো কীভাবে তিনি নাগরিকদের অধিকারের ক্ষেত্রে বিভাজনের বিরুদ্ধে ও আফ্রিকান আমেরিকানদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত নাগরিক অধিকার কর্মীদের নির্যাতন সহ্য করার বিষয়টি তুলির আঁচড়ে ফুঁটিয়ে তুলবেন।

কমিক বইয়ের আঁকা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন লোক কথা বলছে (মার্চ-এ নেট পাওয়েলের আঁকা ছবি © জন লুইস এবং অ্যান্ড্রু আইডিন, সৌজন্যে টপ শেলফ প্রোডাকশনস)
তরুণ জন লুইস সিদ্ধান্তের ব্যাপারে স্থির-সংকল্প। (মার্চ-এ নেট পাওয়েলের আঁকা ছবি © জন লুইস এবং অ্যান্ড্রু আইডিন, সৌজন্যে টপ শেলফ প্রোডাকশনস)

পাওয়েল বলেন, “সহিংসতার কোন দৃশ্য আঁকতে গিয়ে যদি দেখতাম আমার মধ্যে ঘৃণা, আতঙ্ক কিংবা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তাহলে আমি বুঝতে পারতাম আমি দৃশ্যটি সঠিকভাবে ফুঁটিয়ে তুলতে পেরেছি।” তিনি আরো বলেন, “সহিংসতা কুত্‌সিত ও ভীতিজনক, আর তাই আমি সেভাবেই আঁকার প্রক্রিয়াতে খুব দ্রুততার সাথে আমার অরূপান্তরিত অনুভূতিগুলি  আঁকার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতাম ।”

‘ঘটনাবহুল’ …… এবং শিক্ষণীয়

কমিক-কন এর ভক্ত আইডিন মনে করেন “মার্চ” প্রকাশিত হওয়ার পর কংগ্রেসম্যান লুইসকে কমিক-কন উত্‌সবে নিয়ে যাওয়াটা অনেক বড় আনন্দের বিষয় ছিল। আইডিন বলেন, “কংগ্রেসম্যান লুইস কমিক-কনে যেতে পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন এটি ‘ঘটনাবহুল’। লুইস মানুষকে ভালোবাসতেন, এবং নতুন নতুন মানুষের দল দিয়ে ঘিরে থাকা তাঁর জন্য সবসময় আকর্ষণীয় ছিল। তিনি যখন প্রথমবার কমিক-কন-এ গেলেন সে সময়ে তাঁর অটোগ্রাফ নিতে দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়েছিল যা দেখে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন, তার সেই আনন্দভরা মুখ এখনো আমার মনে পড়ে।”

আইডিন স্মৃতিচারণ করেন, লুইস কমিকস উত্‌সবে আসা শিশুদের সাথে নিয়ে সেই বিখ্যাত প্রতিবাদী পদযাত্রা-র অনুকরণে হাঁটা উপভোগ করতেন।

আইডিন বলেন, “কমিক-কন এ পদযাত্রার এই মহড়া কয়েক শত শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হতো এবং আমরা যখন সম্মেলনস্থলে পৌঁছাতাম তখন হাজার হাজার মানুষ আমাদের সেই মিছিলে যোগ দিতো। ….. আমরা নতুন প্রজন্মকে দেখাতে চেষ্টা করতাম কীভাবে তারা পদযাত্রা করবে, যাতে করে তারা লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত থাকে এবং লড়াইকে এগিয়ে নিতে পারে।”

কমিকসের মাধ্যমে লেখা গ্রাফিক উপন্যাস “মার্চ” ত্রয়ী এখন অনেক স্কুলের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে করে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে কয়েক দশক আগে কীভাবে সেই সময়কার তরুণ প্রজন্ম তাদের সমাজের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনেছিল। পাওয়েল বলেন, “যে কোনও যুববয়সীকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে তাদের জীবদ্দশায় এমন কোন মুহুর্ত যদি আসে সেটা অনুশীলন হবে না, এবং এটা আগেও কখনো (অনুশীলন) ছিলো না।”