যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল-রেস্তোরাঁতে হালাল খাবারের চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়ছে

শাহেদ আমানউল্লাহ যখন হালাল ব্যবসার তালিকার তথ্য সমৃদ্ধ ওয়েবসাইট শুরু করেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামী শরিয়ত মেনে খাবার পরিবেশন করা হয় এমন হোটেল-রেস্তোরাঁর সংখ্যা ছিলো ২০০টির মতো।

আর আজ, ২৫ বছর পর তার সেই ওয়েবসাইটে যুক্ত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের হালাল খাবার বিক্রি করে এমন হোটেল-রেস্তোরাঁর সংখ্যা প্রায় ১৩,০০০; যেখানে মালয়েশিয়ান থেকে মেক্সিকান সকল মেনুর হালাল খাবার কিনতে পাওয়া যায়।

এখনো আমেরিকাতে মুসলমান জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম হলেও মুসলমান জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে পিউ রিসার্চ সেন্টারের প্রাক্কলন মতে আমেরিকাতে মুসলমান জনসংখ্যার অংশ ২০১০ থেকে ২০৫০ সময়কালে দ্বিগুণেরও বেশি বাড়বে (০.৯% থেকে ২.১%)। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হালাল হোটেল-রেস্তোরাঁ খোলার হার যেভাবে বাড়ছে তাতে বোঝাই যায় আমেরিকান অর্থনীতিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ বাড়ছে।

জাতিগোষ্ঠী থেকে মূলধারায়

রান্নার বই মাই হালাল কিচেন-এর লেখক ইভান মাফেই বলেন, হালাল খাবার আমেরিকান সমাজের মূলধারায় স্থান করে নিয়েছে।  তার মতে এটি একটি বিবর্তন যা এর আগে ২০ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে মেক্সিকান খাবারের ক্ষেত্রে ঘটেছিল।

“এটি এমন কিছু যা নিয়ে শুধুমাত্র [মুসলিম] জনগোষ্ঠী ১৫ বছর আগে কথা বলত, কিন্তু এখন আমার বন্ধুরা যারা কখনো মধ্যপ্রাচ্যে যায়নি কিংবা হালাল কী তা জানে না তারাও হুমাস, ফালাফেল ও শর্মা কী তা ঠিক জানে এবং তারা এই ধরনের খাবার পছন্দ করে।” (মধ্যপ্রাচ্যের সকল খাবার ইসলামিক আইনের অধীনে অনুমোদিত উপাদান দিয়ে প্রস্তুত করা হয় না, তবে এমন সংস্থা রয়েছে যারা হালাল উপাদান কোনগুলো তার সার্টিফিকেট দেয় এবং খাদ্য প্রস্তুতকারীদের হালাল খাবারের লেবেল সরবরাহ করে)

হালাল খাবারের দুটি ছবি (উভয় ছবি: © ইভন মাফেই)
বায়ে: হালাল ভেড়া ও গরুর মাংসের শর্মা। ডানে: মধ্যপ্রাচ্যের মিষ্টিজাতীয় হালাল খাবার কুনাফে (উভয় ছবি: © ইভন মাফেই)

আমানউল্লাহ বলেন যে, ২০০০ দশকের শুরুতে পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে অল্প কয়েকটি হালাল রেস্তোরাঁ দেখা যেতো, যেগুলো আকারে ছোট এবং মূলত পরিবার দ্বারা পরিচালিত ছিল এবং তারা “রেস্তোরাতে বাসার আমেজে খাবার” পরিবেশন করতো। তাদের গ্রাহকদের বড় অংশ ছিল মনেপ্রাণে আরব কিংবা দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীরা।

ওয়াশিংটনের কাছাকাছি থাকে এমন একজন ইন্সটাগ্রামার সারাহ আব্বাসী (@NotYourAverageHalal) বলেছেন, “আপনি এখন এই এলাকায় যে কোনো সংস্কৃতি বা জাতিগোষ্ঠীর হালাল উপায়ে রান্না করা খাবার খুঁজে পেতে পারেন।” আব্বাসী সকল দেশের হালাল খাবার নিয়ে ইন্সটাগ্রামে পোস্ট বা রিভিউ দিয়ে থাকেন যা পেরুভিয়ান থেকে কোরিয়ান যে কোন কিছু হতে পারে।

বেশি গ্রাহক, ততো কম খরচ

আমানউল্লাহ হালাল রেস্তোরাঁর দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য দু’টি অর্থনৈতিক কারণকে কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন: বাজারে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ এবং রেস্তোরাগুলোতে হালাল পণ্য ক্রয়ে খরচ বেশি না হওয়া।

চার্টে যুক্তরাষ্ট্রে হালাল রেস্তোরাঁর সংখ্যা বৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে (স্টেট ডিপার্টমেন্ট/এস. উইলকিনসন)
(স্টেট ডিপার্টমেন্ট/এস. উইলকিনসন)

আমানউল্লাহ বলেন যে, “মুসলমানদের সংখ্যা দেশের মাত্র ১% কিন্তু প্রধান প্রধান মেট্রোপলিটন এলাকাগুলোয় এই সংখ্যা ৫,৬ কিংবা কোথাও কোথাও ১০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।”

হালাল এবং অন্যান্য মাংসের মধ্যে মূল্যের পার্থক্য কমে আসাতে রেস্তোরাঁর মালিকদের পক্ষে হালাল বেছে নেওয়া সহজ হচ্ছে। আমানউল্লাহ কম খরচের প্রধান কারণ হিসেবে কানসাসের মতো মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলীয় স্টেটে হালাল মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরেন।

ঘটনাক্রমে হালাল

ডেভের হট চিকেন এবং এলিভেশন বার্গার হালাল হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠাকে আমানউল্লাহ “অপ্রত্যাশিতভাবে হালাল” রেস্তোরাঁ বলছেন৷ এলিভেশন বার্গার যখন থেকে মানসম্মত মাংসের জন্য হালাল মাংস সরবরাহকারীকে বেছে নেয় এবং আমানউল্লাহর ওয়েবসাইটে রেস্তোরাঁটি তালিকাভুক্ত হয়, তারপর থেকেই এই চেইন রেস্তোরায় বিপুল সংখ্যক মুসলমান ক্রেতারা আসতে শুরু করে। মুসলমান ক্রেতাদের এই ভীড় রেস্তোরার মালিকদের আকৃষ্ট করে এবং তারা হালালের প্রতি আগ্রহী হয়। এবং পরে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে হালাল বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের রেস্তোরায় হালাল স্টিকার লাগানো হয়,” আমানউল্লাহ বলেন।

ভার্জিনিয়ার ফলস চার্চে লা টিঙ্গেরিয়া একটি ঐতিহ্যবাহী মেক্সিকান রেস্তোরা হিসেবে তাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এবং এর মালিক ডেভিড আন্দ্রেস পেনিয়া কোন এক ছুটির দিনে পরীক্ষামূলকভাবে তার রেস্তোরাঁয় হালাল মেনু রেখেছিলেন এবং ফলস্বরূপ তিনি দেখতে পান যে, ওই সময়ে খাবারের চাহিদা বেশ বেড়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে ডেভিড তার রেস্তোরাঁয় হালাল মেনু চালু করেন।

“নিজেদের রেস্তোরাঁয় হালাল খাবার চালু করায় আমরা সহজেই অনেক প্রতিযোগী থেকে নিজেদেরকে আলাদা করে ফেলতে পেরেছিলাম। যেখানে অন্য কোন মেক্সিকান রেস্তোরাঁ মুসলমান জনগোষ্ঠীকে আলাদাভাবে ক্রেতা হিসেবে বিবেচনা করে নাই বা তাদেরকে পৃথকভাবে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করে নাই, তখন আমরা সেটা করেছি। অন্যরা যখন শুকরের মাংস ও মদ বিক্রি করছিল, তখন হালাল খাবার বিক্রি করার মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাই এবং আমাদের রেস্তোরাঁ অন্য আরেকদল মানুষের জন্য গন্তব্যস্হলে পরিণত হয়, যারা হালাল খাবারের রেস্তোরাঁ খুঁজছিল,” পেনিয়া বলেন।

ক্রেতারা টু-গো ব্যাগে খাবার নিয়ে রেস্তোরাঁ ছাড়ছেন (© অ্যালেক্সি রোজেনফেল্ড/গেটি ইমেজ)
হালাল রেস্তোরাঁ ডেভস হট চিকেন একটি বাজার গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুততম বর্ধনশীল রেস্তোরাঁ। (© অ্যালেক্সি রোজেনফেল্ড/গেটি ইমেজ)

অর্থনৈতিক কারণের বাইরেও আমানউল্লাহ আমেরিকান সমাজে মুসলমানদের বড় পরিসরে একত্রীকরণকেও গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন যে, “আমেরিকাতে হালাল শব্দটিকে কোন খারাপ শব্দ হিসেবে দেখা হয় না।” আর সে কারণেই “আপনি [নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক খাবারের চেইন রেস্তোরাঁ] দ্য হালাল গাইজ দেখতে পাবেন এবং এ নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই!”