
খাদ্য একটি অতি প্রয়োজনীয় সম্পদ হলেও বিশ্বের বিভিন্ন অংশে এর স্বল্পতা আছে। বিশ্বব্যাপী সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ এর ফলে সৃষ্ট সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই লেখায় বর্তমান সময়ের খাদ্য সংকটের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তলিয়ে দেখা হয়েছে।
চরম বৈরী আবহাওয়া বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা বাড়ায়।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকায় সৃষ্টি হচ্ছে আরও বেশি দাবদাহ, খরা, বন্যা, সাইক্লোন ও দাবানল। এসব পরিস্থিতি কৃষকদের জন্য খাদ্য উৎপাদন এবং ক্ষুধার্তদের জন্য সেটি পাওয়ার কাজটি আরও কঠিন করে তুলছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে মনুষ্য-সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব বৈরী আবহাওয়ার ঘটনাগুলো আরও ঘন ঘন দেখা যেতে পারে বা আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে।
“জলবায়ু সংকট মূলত বন্যা, ঝড় ও দাবদাহের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত সংকট,” গত আগস্টে বলেছেন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি লিন্ডা থমাস-গ্রীনফিল্ড। “কিন্তু একইসঙ্গে এটি সরাসরি খাদ্য নিরাপত্তাজনিত সংকটের দিকেও নিয়ে যায়। এটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার কাজটি আরও কঠিন করে তোলে।“
বৈরী আবহাওয়াজনিত ঘটনা এবং সংঘাত হলো বৈশ্বিকভাবে বলপূর্বক বাস্তুচ্যূতির প্রধান দুটি কারণ। হোয়াইট হাউজের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই দুই কারণে বছরে প্রায় ৩ কোটি মানুষ (পিডিএফ, ৬১১ কেবি) তাদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়।

প্রশান্ত মহাসাগরে লা নিনার মতো প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট আবহাওয়া প্রবণতার প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তোলে মনুষ্য-সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন। ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ব্যাখ্যা করে বলেছে যে লা নিনার সময় ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত অঞ্চলে গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৃষ্টিপাতের ওপর, প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে পারে।
জাতিসংঘ খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, ২০২০ সালের শেষদিক থেকে চলমান লা নিনা প্রভাবের কারণে ফসল ও গবাদিপশু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বিশেষভাবে পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, এবং মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবিয় অঞ্চলে।
বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আফ্রিকা
আফ্রিকায় চরম বৈরী আবহাওয়ার ঘটনাগুলো আরও বেশি করে দেখা যাবে এবং আরও তীব্র হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যেভাবে জলবায়ু পরিস্থিতি আফ্রিকার খাদ্য সংকট বাড়িয়ে তুলতে পারে:
- বিশ্বের অন্যান্য জায়গার তুলনায় আফ্রিকার গড় তাপমাত্রা বাড়ছে দ্রুতগতিতে
- আফ্রিকার আর্দ্র অঞ্চলগুলোতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে ৩০% এবং শুষ্ক অঞ্চলে কমছে ২০% হারে।
- আফ্রিকার ৯৫% কৃষক নির্ভর করে বৃষ্টিপাতের ওপর এবং তাদের কোনো সেচ ব্যবস্থা নেই।
ইন্টারন্যাশনাল লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৯ সালের আগে আফ্রিকায় স্বল্প বৃষ্টিপাতের মৌসুম দেখা যেত প্রতি পাঁচ বা ছয় বছর পরপর। এখন, প্রতি দুই বা তিন বছর পরই কৃষকদের স্বল্প বৃষ্টিপাতজনিত সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, আফ্রিকাজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি উৎপাদনশীলতা কমেছে ৩৪%, যা অন্য যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি।
বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চল। ইথিওপিয়া, কেনিয়া ও সোমালিয়ায় অন্ততপক্ষে ৭০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বাজে বৃষ্টি স্বল্পতাজনিত পরিস্থিতি দেখা গেছে। সেখানে টানা চারটি বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি, পরবর্তী মৌসুমটিও ব্যর্থ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সোমালিয়ার প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী খাদ্য অনিরাপত্তার মুখে পড়েছে বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাড়তি মানবিক সহায়তা না পেলে এবছর সেখানকার বেশ কয়েকটি অঞ্চল দুর্ভিক্ষের মুখে পড়বে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
আফ্রিকার অন্যান্য জায়গার মধ্যে মাদাগাস্কারের সবচেয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশের গ্রান্ড সুড অঞ্চলে ১৯৮১ সালের পর সবচেয়ে তীব্র খরা রেকর্ড করা হয়েছে এবং সেখানে টানা তৃতীয় বছরের মতো কম ফলন দেখা গেছে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএফপি।
জলবায়ু পরিবর্তন হুমকির মুখে ফেলেছে আফ্রিকার সামুদ্রিক ও মিঠাপানির মৎস্য উৎপাদনকেও, খাদ্যের জন্য যেগুলোর ওপর আফ্রিকার লাখ লাখ মানুষ নির্ভর করে।
অভূতপূর্ব বন্যা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা
বৃষ্টিস্বল্পতা ও প্রচণ্ড গরম গবাদিপশুর মৃত্যু ঘটায় ও ফসলের ক্ষতি করে। কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতও একই পরিস্থিতি তৈরি করে।
- আগস্টের শেষনাগাদ পাকিস্তান বর্ষণজনিত বন্যায় বিপর্যস্ত হয়েছে , যার কারণে ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
- দক্ষিণ সুদানে বন্যা দেখা গেছে টানা চতুর্থ বছরের মতো।
- নাইজেরিয়ায় ২০২১ সালে মৌসুমী বৃষ্টিপাত শুরু হতে দেরি হয়েছে, যা ৬৫% ফসল উৎপাদন কমিয়েছে । এরপর বৃষ্টি যখন এসেছে, তখন তা রূপ নিয়েছে বন্যায়, যা অবশিষ্ট ফসলের ক্ষতি করেছে।
- লাতিন আমেরিকায় গুয়াতেমালা ও হন্ডুরাসের কিছু অংশে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা এবছর নিচু অঞ্চলগুলোতে বন্যার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলবে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএফপি।

ফেব্রুয়ারি থেকে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবিলায় মানবিক সহায়তা হিসেবে ৮২০ কোটি ডলার এবং উন্নয়নমূলক সহায়তা হিসেবে ২৯০ কোটি ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈরী আবহাওয়াজনিত বিপর্যয় সহনশীল কৃষি-চর্চা গড়ে তোলার দিকে ইঙ্গিত করে সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত ২০ সেপ্টেম্বর বলেছেন, “টেকসই কৃষি উৎপাদনের” লক্ষ্য নিয়ে আগামী পাঁচ বছর বিশ্বজুড়ে ১১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগে কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করবে বাইডেন প্রশাসন।
সেক্রেটারি বলেন, “মানুষের ভালো থাকা নির্ভর করে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর, যেটি আমাদের একসঙ্গে গড়ে তুলতে হবে।”