বিশ্বে সমুদ্র আসলে একটাইসে এক বিশাল জলরাশি, যা কিনা গোটা পৃথিবীর ৭১ শতাংশ দখল করে রেখেছে। এই একটি সমুদ্রই ভৌগোলিকভাবে পাঁচটি মহাসাগর অববাহিকায় বিভক্ত: আটলান্টিক, প্রশান্ত, ভারত, আর্কটিক এবং দক্ষিণ।

একটি সুস্থ গ্রহের জন্য সুস্থ সমুদ্র চাই। পাঁচটি অববাহিকার এই পরস্পর নির্ভরশীলতা এবং সামুদ্রিক পরিবেশের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা নিয়ে আলোকপাত করা হবে ৮ জুন, বিশ্ব সমুদ্র দিবস ২০২১-এ। এবারের প্রতিপাদ্য “সমুদ্র: জীবন ও জীবিকা”।

সমুদ্রের স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ানো পাঁচটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হুমকি এবং প্রতিটি বিষয় মোকাবিলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপের একটি তালিকা নিচে দেওয়া হলো:

জলবায়ু পরিবর্তন

কেন্দ্রীয় আর্কটিক মহাসাগরে জার্মান রিসার্চ ভেসেল পোলারস্টার্ন, সঙ্গে ২০টি দেশের বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত একটি দল, এর সদস্যরা ২০২০ সালে উত্তর মেরুতে একটি অভিযান পরিচালনা করেন। এই মিশন সমুদ্রের বরফে বৈশ্বিক উষ্ণতার নাটকীয় প্রভাব খুঁজে পান, যেটিকে সমর্থন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইট ছবিও। (© অ্যাবাকা প্রেস/অ্যালামি)

জলবায়ু সংকট সমুদ্রেরও সংকট। ১৯৮০ সাল থেকে ২০-৩০ শতাংশ মানবসৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ শুষে আসছে এই সমুদ্র। এবং গত ৫০ বছরে পৃথিবীতে যে উষ্ণায়ন ঘটেছে, তার ৯০ শতাংশের বেশি হয়েছে সমুদ্রে।

সমুদ্র যত তাপ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে; সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, পানির উচ্চতা এবং সমুদ্রের পানিতে অম্লতাও তত বাড়ে। এর ফলে ঝড় ও বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে পারে, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সামুদ্রিক প্রজাতি এবং কমতে পারে জীববৈচিত্র্য।

সমুদ্র রক্ষার জন্য ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে নেট-জিরো (বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ও অপসারণে ভারসাম্য) পর্যায়ে আনার প্রচেষ্টাকে সমর্থন জোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কার্বন কমানোর সমুদ্রভিত্তিক উপায়ের মধ্যে রয়েছে অফশোরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন আনুপাতিক হারে বাড়ানো, জাহাজে ও বন্দরে নিঃসরণ কমানো এবং উপকূলবর্তী “ব্লু কার্বন ইকোসিস্টেমস”যেমন ম্যানগ্রোভ এবং সি গ্রাসপুনর্বহাল করা, যা শুধু কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ ও সংরক্ষণই করবে না, একই সঙ্গে উপকূলও রক্ষা করবে।

অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা

Green sea turtle swimming over coral reefs with azure vase sponges (© Matthew Banks/Alamy)
ক্যারিবিয়ান সাগরে অ্যাযিউর ভাস স্পঞ্জে ভরা প্রবাল প্রাচীরের ওপর সাঁতার কাটছে একটি সবুজ সামুদ্রিক কচ্ছপ। (© ম্যাথিউ ব্যাংকস/অ্যালামি)

মাছ, তিন বিলিয়নের বেশি মানুষের পুষ্টি জোগায় এবং বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশের জীবিকা অর্জনে সাহায্য করে। কিন্তু সামুদ্রিক মৎস্যভান্ডারের এক-তৃতীয়াংশের বেশি সংগ্রহ করা হচ্ছে টেকসই মাত্রার বাইরে।

এভাবে অতিরিক্ত মাছ ধরার প্রভাব পড়তে পারে সমগ্র বাস্তুতন্ত্রে। কমতে পারে মাছের মজুত এবং সংকটের সম্মুখীন হতে পারে সামুদ্রিক কচ্ছপের মতো বিপন্নপ্রায় প্রজাতি। অতিরিক্ত মাছ ধরলে তা দীর্ঘ মেয়াদে মৎস্যজীবীদের জীবিকাকে হুমকিতে ফেলে।

দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই মাছ আহরণ নিশ্চিত করার জন্য সহযোগিতামূলক, বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়ম তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র অগ্রগামী। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তাদের কাঙ্ক্ষিত চাহিদা ঠিক রেখে অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের অনিচ্ছাকৃত আটকপ্রক্রিয়া কমিয়ে আনতে কাজ করে চলেছে। যেমন, অন্য দেশ থেকে চিংড়ি আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করে, সেই চিংড়ি এমনভাবে ধরা হয়নি, যা বিপন্নপ্রায় সামুদ্রিক কচ্ছপের ক্ষতি করে।

 অবৈধ, অজানা ও অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য শিকার

Overhead photo of many fishing boats crowded together (© STR/AFP/Getty)
শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে মাছ ধরায় দেওয়া নিষেধাজ্ঞার মধ্যে অলস পড়ে আছে কয়েকটি নৌকা। এই সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপের অন্যতম কারণ হলো অবৈধ শিকারের মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত মাছ আহরণ। এসটিআর/এএফপি/গেটি)

আন্তর্জাতিক মৎস্যশিল্প যত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে,  সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো অবৈধ, অজানা এবং অনিয়ন্ত্রিত (আইইউইউ) মৎস্য শিকার। এমন মাছ শিকারের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে শত শত কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এর ফলে উপকূলবর্তী যেসব সম্প্রদায় খাদ্য ও জীবিকার জন্য টেকসই মৎস্য শিকারের ওপর নির্ভর করে, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আইইউইউ মৎস্য শিকারের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে অর্থ, মাদক ও মানব পাচারের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডসঙ্গে আরও থাকতে পারে জোরপূর্বক শ্রম।

অবৈধ, অজানা এবং নিয়ন্ত্রণহীন মৎস্য শিকার ঠেকাতে আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরিতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র, যাতে দেশগুলো তাদের মাছ ধরার নৌযান ও জলসীমা তদারকি এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র চায় শক্তিশালী বহুপক্ষীয় কর্মসূচি এবং নীতিমালা কার্যকর করতে। যেমন, পোর্ট স্টেট মেজারস অ্যাগ্রিমেন্ট, যা সামুদ্রিক খাবারের (সি-ফুড) বাণিজ্যে তদারকি আরো বাড়াতে পারে এবং বাজারে আইইউইউ পদ্ধতিতে শিকার করা মাছের প্রবেশ ঠেকাতে পারে।

দূষণ

Plastic bag floating under water (© Andrey Nekrasov/Barcroft Media/Getty)
প্লাস্টিক কখনো পুরোপুরি পচে না; এটি মাছকে আটকে ফেলতে পারে বা মাছ সেটি খেয়ে ফেলতে পারে। (© আন্দ্রে নেক্রাসভ/বারক্রফট মিডিয়া/গেটি)

বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী সমুদ্রে ১৫০ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক দূষণ আছে, যার সঙ্গে প্রতিবছর যোগ হয় আরও ৮ মিলিয়ন টন। সেই হিসাবে প্রতি মিনিটে, আবর্জনা ভর্তি একটি ট্রাকের সমপরিমাণ প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে সমুদ্রে!

পানিতে একবার গেলে, প্লাস্টিক কখনোই সম্পূর্ণ পচতে পারে না। মাছ, সাগরের পাখি, কচ্ছপ এবং সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী এটি খেয়ে ফেলতে পারে অথবা এর ভেতরে আটকে যেতে পারে।

সামুদ্রিক আবর্জনা কমাতে নিজ দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে সাহায্য করে; যার মধ্যে রয়েছে, মাছ ধরার পরিত্যক্ত সরঞ্জামের সমুদ্রে প্রবেশ ঠেকানো। যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়ে গবেষণার উদ্যোগ নেয় এবং প্লাস্টিক আবর্জনা হ্রাসে উদ্ভাবনকেও উৎসাহিত করে।

ক্রমহ্রাসমান সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য

Glacier ice and icebergs in front of the mountains and glaciers (© Samantha Crimmin/Alamy)
এই প্যারাডাইজ উপসাগরের মতো অ্যান্টার্কটিকার সামুদ্রিক আবাসস্থলগুলো রক্ষায় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র। (© স্যামান্থা ক্রিমিন/অ্যালামি)

সামুদ্রিক জীবন যখন হুমকির মুখে পড়ে, তখন সংরক্ষিত এলাকা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়, যা রক্ষা করতে পারে জীববৈচিত্র্য ও বিপন্ন আবাসস্থল, সহায়তা জোগাতে পারে মৎস্য চাষে, বাড়াতে পারে কার্বন শোষণ ও সংরক্ষণ এবং গড়ে তুলতে পারে সমুদ্রের সহনশীলতা।

২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের ৩০ শতাংশ জল ও স্থলভাগ সংরক্ষণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। যেসব এলাকা সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, সেগুলোর অধিকাংশের অবস্থান সমুদ্রতীরে হলেও অ্যান্টার্কটিকার জলরাশির মতো কিছু এলাকা পড়েছে দূর সমুদ্রে। যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ মহাসাগরের সংরক্ষিত সামুদ্রিক এলাকাসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে সহায়তা দিয়ে চলছে।