
যুক্তরাষ্ট্রে সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার শ্রম দিবস হিসেবে পালিত হয়। দীর্ঘ সপ্তাহান্তের এই দিনে শ্রমজীবীদের অনেকেই উপার্জিত ছুটি কাটাবেন এবং সকল আমেরিকান শ্রমজীবীদের অধিকারের গুরুত্বের কথা স্মরণ করবেন।
এই বছর, শ্রম দিবসে বিশেষভাবে সহিষ্ণু ও অভিঘাতসহনশীল শ্রমজীবীদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর উপযুক্ত সময়। কারণ, তারা করোনাভাইরাস মহামারী চলাকালে আমেরিকাকে দৃঢ় ও শক্তিশালী থাকতে সহায়তা করছেন। তারা শিশুদের শিক্ষাদান করছেন, অসুস্থদের পরিচর্যা করছেন এবং আমেরিকান জনগণের কাছে দৈনন্দিন জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিচ্ছেন। এখানে এমন কয়েকজন আমেরিকান শ্রমজীবী মানুষের জীবনের গল্প বলা হয়েছে।
‘আপনাকে সতর্ক ও যত্নশীল হতেই হবে’

প্রতিদিন, ইউনিফর্ম পরার আগে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পোস্টাল সার্ভিসের ডাক বিলি করার জন্য সামনের দরজা খোলার আগে জেমস ড্যানিয়েলস প্রার্থনা সেরে নেন। গত ১৬ বছর ধরে ৫৯ বছর বয়সী ড্যানিয়েলস একই রাস্তা ধরে ছুটে চলছেন এবং একই এলাকায় ডাক বিলি করছেন। তাঁর কাজের এলাকা ক্যালিফোর্নিয়ার সান ক্লিমেন্টে ৮০৮ জন কাস্টমার রয়েছেন। তাঁর কাস্টমাররা বিল, ওষুধ ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র সরবরাহের জন্য ড্যানিয়েলসের উপর নির্ভর করেন।
“এটাই তাদের জীবন, যা আমি তাদের ডাকবাক্সগুলোতে পৌঁছে দেই,” ড্যানিয়েলস বলছিলেন। “আপনি যদি এই কাজ করেন তাহলে আপনাকে সতর্ক ও যত্মশীল হতেই হবে।”
কোভিড-১৯ প্রতিদিনকার জীবন বদলে দিয়েছে। ড্যানিয়েলস স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি ব্যস্ত থাকেন। তাঁকে মানুষের বাড়িতে গাদা গাদা জিনিসপত্র এখন পৌঁছে দিতে হচ্ছে। তার সরবরাহ করা জিনিসপত্রের তালিকায় এখন বড় বড় বস্তু যেমন, তোশক, আসবাবপত্র এবং ওয়াগনও রয়েছে।
এখন অনেক কাজ করতে হচ্ছে বটে কিন্তু এটি “ভালো কাজ,” ড্যানিয়েলস বলেন। “ভালো কাজ বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে এতে মানুষের উপকার হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর এই সময়টা পার করতে মানুষকে সহায়তা করছে।”
তিনি নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য ডাক গাড়িটি জীবাণুনাশক দিয়ে পরিস্কার করেন। তিনি যখন কাজে থাকেন সবসময় মাস্ক পরেন। প্রতিদিন কাজের শেষে তিনি গোসল করেন এবং ইউনিফর্ম ধুয়ে ফেলেন।
ড্যানিয়েলসের কর্মএলাকার গ্রাহকেরাও তাঁর জন্য অপেক্ষা করেন। তারা তাঁর ক্লান্তি দূর করতে তাঁকে পানি ও গ্যাটোরাড পানীয় উপহার দেন। তারা তাঁকে এতো বেশি মুখে পড়ার মাস্ক দিয়েছে যে, এখন কেউ দিতে চাইলে তিনি বিনীতভাবে না বলেন। তারপরও তাঁকে দীর্ঘদিনের একজন গ্রাহকের কাছ থেকে ডাকগাড়ির ছবিসহ হাতে-সেলাই করা মাস্ক উপহার হিসেবে গ্রহণ করতে হয়েছিল। ড্যানিয়েলসের ভাষায় তিনি “পৃথিবীর সেরা নারী” এবং মাস্কটি দেয়ার সময় সেই নারী ড্যানিয়েলসকে বলেছিলেন যে, তিনি মাস্কটি তৈরি করেছেন কারণ “জেমস, আমরা চাইনা আপনার কোন কিছু হোক। আমরা সত্যিই চাই না।”
‘সৃজনশীল হতেই হবে’

তেলাপোকা, ময়ূরের পালকের তৈরি মাথার ব্যান্ড, কার্ডবোর্ড কেটে তৈরি করা নিজের বিশাল আকারের ছবি এবং আরো অনেক সৃজনশীলতার সমন্বয়ে জোয়ান কলিন্স ব্রক মহামারীর মাঝেই দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন।
৫৪ বছর বয়সী ব্রক লুইভেলের নিকটবর্তী কেনটাকির গোশনের সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে ভাষা শিল্প ও সমাজবিজ্ঞান বিষয় পড়ান। বছরের শুরুতে মহামারীর প্রথমদিকে অনলাইনে ভার্চুয়াল ক্লাস করা নিয়ে কিছুটা ভীতি কাজ করলেও স্কুলের ৩৭০ জন শিক্ষার্থী অল্পদিনের মধ্যে কিছু নতুন নিয়ম শিখে নিয়েছিল। ব্রক কোলাহলকারী শিক্ষার্থীদের সবসময় মাইক্রোফোন বন্ধ করার কথা মনে করিয়ে দেন।
শিক্ষার্থীরা স্কুলে না এলেও ব্রক নিয়মিত স্কুলে যান এবং ক্যামেরার সাহায্যে শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাসরুমে তাদের প্রিয় খেলার জায়গা ও অন্য যা কিছু তারা মিস করে সেগুলো দেখান। তিনি শিশুদের পড়া শেখানোর জন্য ওয়ার্কশিটের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের খেলা ব্যবহার করেন। এবং তার নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা পাপেট শো-ও করেছে।
“আমাদেরকে সৃজনশীল হতেই হবে,” বলছিলেন ব্রক, যিনি ১৮ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। তিনি বলেন, অনলাইন ক্লাস শেষে, দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অনলাইন থেকে সহজে বের হতে চায় না, দেখা যায় তারা প্রায়ই ভিডিও চালু রেখে সবাই মিলে দুপুরের খাবার খাচ্ছে।।
কোভিড এর এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ ও সহায়তা কমে যাওয়ায় শিশুদের কারো কারো অসুবিধা হওয়ার কথা ভেবে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে, অনলাইনে ক্লাস নেওয়ায় শিশুদের জন্য ভালো হয়েছে, তারা অন্তত নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারছে। শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারগুলো ব্রককে তাঁর কাজে উত্সাহিত করতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন, এক শিক্ষার্থীর মা কার্ডবোর্ড কেটে ব্রকের আকৃতি বানিয়ে তার সাথে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর আলাদাভাবে ছবি তুলে ব্রককে দিয়েছেন।
ব্রকের ক্লাসরুমের পোষা প্রাণী হ’ল মাদাগাস্কারের হিসিং জাতের তেলাপোকা, যা ফড়িং শিকার করে। এগুলোর সাহায্যে ব্রুক শিশুদের জীবনচক্র শেখান এবং যা আবার শিক্ষার্থীদের পোকামাকড়ের ভয় কাটিয়ে উঠতেও সহায়তা করে। কেনটাকি ডার্বির আগের বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক তেলাপোকা দৌড় অনুষ্ঠানে পোকামাকড়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। (শিক্ষার্থীরা বিখ্যাত আমেরিকানদের আসল নামের অনুকরণে পোকামাকড়ের হাস্যকর নাম দিয়ে থাকে। এই বছরের নামগুলোর মধ্যে একজন নামকরা গায়ক, একজন রাজ্য গভর্নর এবং এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রুথ বদর গিন্সবার্গ ছিল।)
এবছর যখন কেনটাকি ডার্বি স্থগিত ঘোষণা করা হলো, ব্রক ক্লাসরুমেই বার্ষিক তেলাপোকা দৌড়ের আয়োজন করেছিলেন। পুরো বিষয়টিকে আকর্ষণীয় করতে এবং কেনটাকি ডার্বির মাঠের দৌড় প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি করতে তিনি মাথায় ময়ূরের পালকের তৈরি ব্যান্ড পরেছিলেন। ব্রক বলেন, ক্লাসরুমের ট্র্যাকে আমি যখন প্রতিযোগীদের ডাকছিলাম তখন এমনভাবে ঘোষণা করছিলাম যেন কেনটাকি ডার্বি মাঠে ঘোষণা করছি: ‘তারা এখনই দৌড় শুরু করবে, রোচ বদর গিন্সবার্গ অ্যান্টেনার মাধ্যমে এগিয়ে আছেন।’
অন্যান্য শিক্ষকদের মতো ব্রকও ক্লাসরুমে ফিরতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি নিজের জন্য স্বচ্ছ ভিনাইলের তৈরি মুখের শিল্ড ও মাস্ক কিনেছেন, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের সাফল্যে তার খুশি ও হাসিমুখ কিংবা বিশৃংখলা তৈরি করলে তাঁর রাগী মুখ দেখতে পায়। “এভাবেই শিশুরা তাদের শিক্ষকের চেহারা পুরোপুরিভাবে ফিরে পাবে — আপনি সেই চেহারাটি কেমন জানেন,” ব্রক বলেন।
‘আমরা এখনও নিরাপদ’

অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যখন প্রথম বন্ধ হয়, সারাহ রিভাস খুশিমনে তাঁর স্বামী, ৯-বছর-বয়সী মেয়ে ও ২-বছর-বয়সী ছেলের সাথে সময় কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু নিজ কর্মস্থল অ্যানিজ প্যারামাউন্ট স্টেকহাউজে না গিয়ে বাসায় থাকাটা কিছুদিনের মধ্যে তার কাছে “সত্যিই, সত্যিই বিরক্তিকর” হয়ে উঠল।
জুনে রেস্তোঁরাটি আবার চালু হওয়ার পরে, তিনি কাজে ফিরে যান; এবং সাহায্যকারী রাধুনী (প্রেপ কুক) ও কখনো কখনো অতিথিদের/কাস্টমারদের অভ্যর্থনা জানানোর দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন। এই সময়ে তিনি দেখতে পান নিয়মিত কাস্টমাররা ফিরে আসতে শুরু করেছে এবং সহকর্মীদের সাথেও পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন হয়। “কাজে ফিরে আসতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ” সারাহ রিভাস বলেন, তার স্বামীর নির্মাণ কাজের ঘণ্টা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আমরা এখনও নিরাপদ।”
রিভাস বলেন, “সবকিছুই অন্যরকম হয়ে গিয়েছে, তবে আমরা ভালো আছি।” তিনি ১২ বছর ধরে রেস্তোরাতে কাজ করছেন। তিনি বলেন, “আমরা সব নিয়ম মেনে চলছি।”
নতুন যা ঘটছে তার মধ্যে রয়েছে মাস্ক ও গ্লাভস পরা….. এবং প্রচুর টয়লেট পেপার বিক্রি করা।
‘কষ্টগুলো থেকে ভালো কিছু তৈরি করার এখনই সময়’

ক্রিস কুর্থ (৪৫) কয়েক বছর ধরে সিয়ানা ফার্মে কঠোর পরিশ্রম করছেন । কাজে একটি বিরতি নেয়ার কথা ভাবছিলেন। কোন কোন বছর অর্থকড়ি উদ্বৃত্ত থাকে ব্যবসায় পুনঃবিনিয়োগ করার জন্য। তবে সেটা সব বছর থাকে না।
এসময়েই কোভিড-১৯ আঘাত হানলো। তাঁর ১৪-বছর-বয়সী মেয়ের স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বন্ধুদের সাথেও দেখা সাক্ষাত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কুর্থের স্ত্রী নামকরা শেফ আনা সোর্টান বোস্টন-এলাকায় তাঁর তিনটি রেস্তোরায় বসে খাওয়া বন্ধ করে, শুধু খাবার কিনে নিয়ে যাওয়া বা পার্শ্বেল নেয়ার ব্যবস্থা করলো, আর এসবের মানে হলো কুর্থের খামারের সবজি বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়া।
“আমার মনে হলো আমাদের জীবনে ঘটে চলা কষ্টগুলো থেকে ভালো কিছু তৈরি করার এখনই সময়,” কুর্থ বলেন, যিনি মেয়ের নামে ম্যাসাচুসেটসের সুডবুরিতে অবস্থিত তাঁর খামারের নাম রেখেছেন সিয়ানা।
মানুষজন বাসাবাড়িতে বেশি বেশি রান্না শুরু করার পর স্থানীয় সুপারমার্কেটের তাকগুলো খালি দেখে হতাশ হয়েছিল। এই সময়ে সিয়ানা ফার্মের কমিউনিটি সাপোর্টেড এগ্রিকালচার প্রোগ্রাম-এর কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। এই ব্যবস্থায় নিবন্ধনকারী নিয়মিত ভোক্তাদের কাছে সরাসরি পণ্য বিক্রি করা হয়। খবর পেয়ে লোকেরা খামারে ভীড় করল। বেশিরভাগ বছরে প্রায় ৪০০ ক্রেতা খামার থেকে সবজিভর্তি বাক্স কিনতে পারে, কিন্তু এবছর নিবন্ধিত পরিবারের সংখ্যা ১,৭০০। কুর্থ দ্রুততার সাথে অন্য কৃষকদের কাছ থেকে তাজা রুটি ও স্ট্রবেরি জ্যাম কিনে নিলো, জমিতে আরো বেশি ফসল রোপন করলো, এবং তার সরবরাহ ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনলো।
জুলাইয়ের শেষ নাগাদ, কুর্থের আয় ২০১৯ সালের সারাবছরের আয়ের তিন গুণ হলো। এখন তার ব্যবসায় কমিউনিটির অংশ বেড়ে ৯০% হয়েছে, যা মহামারী শুরু হওয়ার আগের চেয়ে ৩৩% বেশি। কুর্থ জানেন যে, এই বছর অনেক ব্যবসা টিকে থাকতে লড়াই করছে এবং তিন মনে করেন যে, তার পরিবার বিশেষভাবে সৌভাগ্যবান। কঠিন এই সময় তার খামারকে এমন এক পথে নিয়ে গিয়েছে যেখানে তিনি যেতে চেয়েছিলেন, এবং তার খামারের পুরো কার্যক্রমকে এখন আর্থিকভাবে কমিউনিটি সহায়তা করছে।
“একেই বলে স্বপ্ন সত্যি হওয়া,” কুর্থ বলেন।