প্রতিবেদন: রাশিয়ার ফিলট্রেশন কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে

রাশিয়ান ভাষায় “শিশু” লেখা বাস থেকে নামছে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুরা। (©লিও কোরিয়া/এপি ইমেজেস)
ইউক্রেনের মারিয়াপোল থেকে জাপোরিঝিয়াগামী মানুষদের অবশ্যই ফিলট্রেশন চেকপয়েন্ট পেরোতে হয়। (©লিও কোরিয়া/এপি ইমেজেস)

ইয়েলের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাবের একটি নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ার সরকার পূর্ব ইউক্রেনের ফিলট্রেশন এলাকায় সম্ভাব্য নির্যাতন ও জোরপূর্বক শ্রমে জড়িত। স্যাটেলাইট ছবিতে একটি কেন্দ্রে কবরের সম্ভাব্য উপস্থিতিরও ইঙ্গিত মিলেছে ৷

প্রতিবেদনটি ওপেন সোর্স ডেটার সঙ্গে ক্রস-রেফারেন্স করা উচ্চ-রেজ্যুলুশনের স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করেছে। এতে কেবলমাত্র সেই স্থাপনাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলোর অবস্থান ও কর্মকাণ্ড পাঁচটি স্বাধীন সূত্রের মাধ্যমে নিশ্চিত করা গেছে।

স্টেট ডিপার্টমেন্ট গত ২৫ আগস্ট এক বিবৃতিতে বলেছে “প্রেসিডেন্ট পুতিন ও তার সরকার এই ক্রমাগত নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত থাকার দায় এড়াতে পারবে না। তাদেরকে জবাবদিহি করতেই হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও আমাদের অংশীদারেরা নিরব থাকবে না।”

ফিলট্রেশন স্থাপনা কী?

প্রতিবেদনটি অনুযায়ী, ফিলট্রেশন স্থাপনার মধ্যে রয়েছে:

  • নিবন্ধন পয়েন্ট, যেখানে ইউক্রেনীয় নাগরিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য করা হয় এবং একটি “ফিলট্রেশন সনদ” ইস্যু করার আগে তাদের ব্যক্তিগত ডেটা ও বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যা তাদের নিজ-দেশের মধ্যে চলাচলের স্বাধীনতা দেয়। রেজিস্ট্রেশন পয়েন্টে উত্তীর্ণ না হলে, তাদেরকে পাঠানো হয়:
  • হোল্ডিং এলাকায়, যেখানে রেজিস্ট্রেশনের জন্য অপেক্ষমান ব্যক্তিরা থাকেন;
  • জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে, যেখানে অনেককে নির্যাতন করা হয়;
  • আটক-কেন্দ্রে, যেখানে বেসামরিক ব্যক্তিদের স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদী কারাবাসে পাঠানো হয়।

রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত এলাকা ছেড়ে ইউক্রেন-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা বেসামরিক ইউক্রেনের নাগরিকদের ফিলট্রেশন কেন্দ্রগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। এই কেন্দ্রগুলো কৌশলগতভাবে রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের প্রধান সড়ক, নদী এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পথ বরাবর অবস্থিত। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, “তিনটি ওব্লাস্ট [প্রশাসনিক অঞ্চল] থেকে পালিয়ে আসা, রাশিয়া না-যেতে চাওয়া সকল মানুষ এই [ভাসিলিভকা] চেকপয়েন্ট অবশ্যই পাড়ি দিতে হয় ।”

গাড়ীতে বসা নারী, পুরুষ ও শিশুরা (©লিও কোরিয়া/এপি ইমেজেস)
রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত মারিউপোল থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া এমন ইউক্রেনীয় নাগরিকদের ইউক্রেন-নিয়ন্ত্রিত জাপোরিঝিয়া পৌঁছানোর আশায় কয়েক দিন ধরে অপেক্ষা করতে হয় ফিলট্রেশন চেকপয়েন্ট পেরোনোর জন্য। (©লিও কোরিয়া/এপি ইমেজেস)

বেসামরিক নাগরিকদেরও এক জায়গায় জড়ো করা হয় এবং জোর করে ফিলট্রেশন স্থাপনায় নিয়ে যাওয়া হয়।

ইউক্রেনের সাবেক ন্যায়পাল লুডমিলা ডেনিসোভা বলেছেন যে, গত ১৪ জুন পর্যন্ত ২৭৬,০০০ শিশু সহ কমপক্ষে ১৭ লাখ ইউক্রেনীয় নাগরিককে ফিলট্রেশন স্থাপনাগুলোর মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। রাশিয়ান কর্মকর্তারা রিপোর্ট করেছেন যে সংখ্যাটি এর দ্বিগুণ – প্রায় ৩৪ লাখ মানুষ, যার মধ্যে পাঁচ লাখেরও বেশি শিশু রয়েছে।

রাশিয়ার সরকারের ফিলট্রেশন কেন্দ্র ব্যবহারের ইতিহাস রয়েছে। প্রথম (১৯৯৪-১৯৯৯) ও দ্বিতীয় (১৯৯৯-২০০৯) চেচেন যুদ্ধের সময় চেচনিয়ায় একই রকম ফিলট্রেশন কেন্দ্র স্থাপন করেছিল রাশিয়া। বন্দীরা সেখানে নির্যাতন, মারধর ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে রিপোর্ট করেছেন।

২০০০ সালে, চেচেন স্থাপনাগুলো সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, “অনেকে ‘অদৃশ্য’ হয়ে যান কারণ রুশ কর্মকর্তারা তাদের জনবিচ্ছিন্ন বন্দিশিবিরে আটকে রাখে। আত্মীয়রা ঘুষ দিলে কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত মুক্তি পান। অন্যেরা কখনোই ফিরে আসেন না।”

একুশটি ফিলট্রেশন স্থাপনা চিহ্নিত

গাড়ীতে থাকা মানুষদের পরিচয় যাচাই করছে সশস্ত্র ব্যক্তিরা (© আলেক্সি আলেক্সান্দ্রভ/এপি ইমেজেস)
২৭ মার্চ, ইউক্রেনের মারিয়াপোলের শহরতলীতে একটি চেকপয়েন্টে গাড়ী তল্লাশীকরছে তথাকথিত দোনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিকের সশস্ত্র ব্যক্তিরা। (© আলেক্সি আলেক্সান্দ্রভ/এপি ইমেজেস)

ইয়েলের প্রতিবেদনে দোনেৎস্ক প্রশাসনিক অঞ্চলের আশপাশে ২১টি যাচাইকৃত ফিলট্রেশন স্থাপনার বিশদ বিবরণ মেলে, যাদের কিছু প্রক্রিয়াকরণের জন্য, কিছু ধরে রাখা বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, এবং কিছু আটকে রাখার জন্য। ছয় মাস আগে ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসনের পরপরই ইউক্রেনের স্কুল, বাজার, প্রশাসনিক ভবন ও কারাগারগুলো ফিলট্রেশন স্থাপনা তৈরির জন্য দখল করে নেয় রাশিয়া সরকার।

প্রতিবেদনে উদ্ধৃত প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, নিবন্ধন পয়েন্টগুলোর অবস্থা ছিল মানুষের ভিড়ে ঠাসা এবং অস্বাস্থ্যকর। ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকেরা বলছেন যে তারা খাবার, পানি বা বাথরুম ছাড়াই কয়েক দিন অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়েছেন। অপেক্ষায় বেশ কয়েকজন মারাও গেছেন।

কারাগারের অবস্থা আরও খারাপ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “আটককেন্দ্রগুলোতে, বেসামরিক ব্যক্তিদের প্রায়ই যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে রাখা হয় এবং সেখানে অমানবিক অবস্থা ও আচরণ … এবং নির্যাতনেরও শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে।”

১০০ জন ধারণক্ষমতার কারাগারে ৮০০ ইউক্রেনীয়কে রাখা হয়েছে। সেখানে বড়জোর হাঁটু গেড়ে বসার মতো জায়গা মেলে এবং দিনের পর দিন বাথরুম ব্যবহার ছাড়াই থাকতে হয়।

ইউক্রেনীয়দের সঙ্গে অমানবিক আচরণ

বেসামরিক নাগরিক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের জোর করে কাপড় খুলে তল্লাশি করা হয়। প্রতিবেদনে উদ্বৃত প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণে বলা হয় আটক ব্যক্তিদের ট্যাটু, পোশাক, এমনকি ব্যক্তিগত সেলফোনে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে ইউক্রেনের প্রতি আনুগত্যের ইঙ্গিত পেলেও তাদের মারধর করা হয়

হোল্ডিং এবং ডিটেনশন স্থাপনা থেকে পালিয়ে যাওয়া অন্যেরা বর্ণনা করেছেন:

  • বৈদ্যুতিক প্রবাহের ব্যবহার সহ শারীরিক নির্যাতন।
  • অনাহার, প্রতিদিন মাত্র ৫০ গ্রাম রুটি প্রদান।
  • গণকবর খনন করতে বাধ্য করা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটক ইউক্রেনীয় সৈন্যদের প্রতি আচরণ আরও খারাপ। এপ্রিল মাসে কারাগার থেকে পালিয়ে আসা এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন যে কীভাবে “নতুন বন্দী সেনাদের কলোনিতে আনা হয়েছিল। [রুশ সৈন্যরা] তাদের পেটাতে শুরু করে। রক্ষীরা গোটা কারাগারে রেডিও চালু করে রেখেছিল এবং সেই সময় এই বন্দীদের মারধর করা হয়েছিল,” তিনি বলেন।

স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছে, “ইউক্রেনের জনগণ ন্যায়বিচার আশা করে, এবং যতদিনই লাগুক যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে থাকবে।”