দাসপ্রথার বিরুদ্ধে ইলিনয়ের একজন আইনজীবী তার নৈতিক যুক্তিতর্ক দিয়ে দেশটিকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার পর থেকে আমেরিকার নির্বাচনী বিতর্কে অনেক পরিবর্তন এসেছে।

সালটা ছিলো ১৮৫৮, স্টেফান ডগলাস’র সাথে বিতর্কে উপস্থাপিত যুক্তিতর্কের মাধ্যমে আব্রাহাম লিংকন সে বছর সিনেট পদে জিততে পারেননি। তবে সেই বিতর্কের বিবরণী সারা দেশে বিতরণ করা হয়েছিলো যা দু’বছরের মাথায় লিংকন’কে হোয়াইট হাউসে পৌঁছে দিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলো।

এক শতাব্দীরও বেশি সময় পরে ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু করে প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেই জাতীয় বিতর্কানুষ্ঠান হয়ে আসছে। এ বছর প্রধান দলগুলোর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মধ্যে তিনটি এবং তাঁদের সহযোগী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মধ্যে একটি বিতর্কের সময়সূচী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিতর্কে কিছু পরিবর্তন আসবে। এবারের বিতর্কগুলো আগের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে কেননা জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিধি-নিষেধের কারণে এবার সাধারণ প্রচারণা অনুষ্ঠানাদির সুযোগ কম।

১৮ সেপ্টেম্বর ১৮৫৮ তারিখে স্টিফেন ডগলাস’র সাথে আব্রাহাম লিংকন’র বিতর্কানুষ্ঠানের চিত্রকর্ম (© ফোটোসার্চ/গেটি ইমেজেস)
১৮ সেপ্টেম্বর ১৮৫৮ তারিখে স্টিফেন ডগলাস’র সাথে আব্রাহাম লিংকন’র বিতর্কানুষ্ঠানের চিত্রকর্ম (© ফোটোসার্চ/গেটি ইমেজেস)

লিংকন-ডগলাস বিতর্ক থেকে এখনকার বিতর্ক অনেক দিক থেকেই আলাদা- তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে প্রত্যেক প্রার্থী একটানা এক ঘণ্টা বা আরো বেশী সময় ধরে বক্তব্য দেয়ার বদলে এখনকার প্রার্থীরা টেলিভিশনে ৯০ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্বে সাংবাদিকদের সাথে পালাক্রমে কথা বলে থাকেন। টেলিগ্রাফের মাধ্যমে বিতর্কের বিবরণী পাঠানোর বদলে লক্ষ লক্ষ মানুষ টেলিভিশনে বা সামাজিক মাধ্যমে সরাসরি এই অনুষ্ঠান দেখে। সেইসাথে বিতর্কের আগে ও পরে প্রার্থীদের বক্তব্য এবং তাঁদের প্রতি দর্শকদের প্রতিক্রিয়াগুলো সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কানুষ্ঠানগুলোতে সাধারণত রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থীরা অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু অন্যান্য দলের প্রতিনিধি প্রার্থীরা থাকেন না। তবে, তৃতীয় কোন দলের প্রার্থী/স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ব্যালটে অন্তর্ভুক্ত হবেন।

নির্দলীয় লিগ অফ উইমেন ভোটারস বহু বছর ধরে এই বিতর্ক পরিচালনা করে আসছিলো কিন্তু ১৯৮৮ সালে দলীয় প্রার্থীরা এর নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন থেকে জনমত জরিপে উল্লেখযোগ্য সমর্থনপ্রাপ্ত প্রার্থীরাই কেবল এই বিতর্কে অংশ নিতে পারেন। সেই থেকে মঞ্চে মাত্র দু’জন প্রার্থীই শরৎকালীন বিতর্কে অংশ নেন, যদিও ১৯৯২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী রস পেরো’কে এই বিতর্কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।

তাঁরা কি ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারেন?

পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়’র অ্যানেনবার্গ পাবলিক পলিসি সেন্টার’র পরিচালক ক্যাথলিন হল জেমিসন বলেন, ভোটারদের ওপর বিতর্কের সঠিক প্রভাব বিশ্লেষণ করা কঠিন, তবে স্পষ্টতই এটা “গুরুত্বপূর্ণ বিষয়”। “নির্বাচনে এটা এমন একটা সুযোগ যখন একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে একই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মধ্য দিয়ে প্রধান দলের প্রার্থীদের অবস্থানগত পার্থক্যগুলো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আপনি তাদের মনোভাব এবং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য ঘটনা অনুমানে তাদের সক্ষমতা সম্পর্কেও একটা ধারণা পাবেন।”

বার্মিংহামের ইউনিভার্সিটি অফ আলাবামা’র যোগাযোগ বিদ্যার অধ্যাপক বিল বেনোইট বলেন, বিতর্কের মাধ্যমে ভোটাররা প্রার্থীদের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা নেবার পাশাপাশি আমেরিকার দর্শকেরা বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয় এবং সে বিষয়ে প্রার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে জানতে পারে।

২০০৪ সালে ডেনভার নিবাসী ভোটার তেরেসা নাতালে শিশু সন্তান কোলে নিয়ে ৬ বছরের ছেলের সাথে প্রেসিডেন্ট-নির্বাচনী বিতর্কানুষ্ঠান দেখছেন। (© ডেভিড জালুবউস্কি/এপি ইমেজেস)

বেনোইট বলেন, “বিতর্কানুষ্ঠানের ফলে কিছু ভোটারের ভোটের পছন্দে পরিবর্তন আসলেও সাধারণত তাদের আগের মনোভাবই আরো জোরালো হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার হারজিত বিতর্কানুষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে না, তবে এই বিতর্ক নির্বাচনী প্রচারণাগুলোকে অবশ্যই জোরালো বা দুর্বল করতে ভূমিকা রাখে।”

বেনোইট বলেন, “আরো যে বিষয়টা লিংকনের কাল থেকে পুরোপুরি আলাদা সেটা হলো বিতর্ক অনুষ্ঠান দেখার পাশাপাশি সে বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে অন্যান্যদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার সাম্প্রতিক প্রবণতা। এর ফলে প্রার্থীরা আসলে কী বলছেন সেটা অনুধাবনের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।”

এবছর কোভিড-১৯’র কারণে দর্শকের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়াই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হতে পারে। জেমিসন’র মতে, এতে বিতর্ক আরো উন্নত হবে, কেননা জনতার হর্ষধ্বনীর দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই ভোটারদের মতামত তৈরি হবে।

ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড’র সরকার ও রাজনীতি বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক স্টেলা এম. রৌস বলেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কগুলো আলাদা কেননা এখানকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা দলীয় পদ্ধতির চেয়ে ব্যক্তি-প্রার্থীর ওপর বেশি নির্ভরশীল।

তিনি বলেন, “এই দেশে নির্বাচনী বিতর্ক ব্যক্তি-প্রার্থীকেন্দ্রিক বিষয়।”

বিতর্কের পরে অনেক সময় বিতর্কের চটকদার ও ব্রিবতকর বিষয়গুলো সংবাদমাধ্যমে প্রাধান্য পায়। আবার অনেক সময় সত্যকে ছাপিয়ে প্রতিক্রিয়াগুলোই মুখ্য হয়ে ওঠে। ১৯৮৮ সালের প্রেসিডেন্ট বিতর্কে ৪০ বছর বয়সী ড্যান কোয়েল যখন বলেন যে, প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে কংগ্রেসে জন এফ. কেনেডি’র যতটা অভিজ্ঞতা ছিলো সেটা তারও আছে তখন লইড বেন্টসেন তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেন।

আমি জ্যাক কেনেডির সাথে কাজ করেছি। আমি জ্যাক কেনেডিকে চিনতাম। জ্যাক কেনেডি আমার বন্ধু ছিলেন। বেন্টসেন পাল্টা জবাব দেন, সিনেটর, আপনি মোটেও জ্যাক কেনেডি নন। তবে, জেমিসন মূলসত্যটা তুলে ধরে বলেন যে, কোয়েল তাঁর অভিজ্ঞতার বিষয়টা সঠিকভাবেই বলেছেন, কিন্তু সেটা কথার তালগোলে হারিয়ে গেছে।

১৯৮৮ সালে নেব্রাস্কা’র ওমাহায় বিতর্ক শেষে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বেন্টসেন (বামে) এবং কোয়েল হাত মেলাচ্ছেন। (© রন এডমন্ডস/এপি ইমেজেস)

তারপরও, প্রার্থীরা কে কীভাবে প্রশাসন চালাবেন সে বিষয়ে ভোটাররা জানতে পারেন এই বিতর্কের মাধ্যমে। জেমিসন বলেন, যদিও সংশয়বাদীরা অনেক সময় অভিযোগ করেন যে, রাজনীতিবিদেরা তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন না- তবে তথ্যপ্রমাণে উঠে আসা বাস্তবতা ভিন্ন। প্রেসিডেন্টগণ তাঁদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর গড় ৬০ ভাগই কার্যকর করার প্রচেষ্টা নিয়ে থাকেন।

জেমিসন বলেন, “তাঁরা কে কী করবেন সে বিষয়ে বেশ নাটকীয় পার্থক্য আপনার চোখে পড়বে এই বিতর্কগুলোতে।”

জেমিসনের মতে ১৯৮০ সালের বিতর্ক একটা ভালো উদাহরণ। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রকৌশলী ছিলেন। তাঁর বক্তব্য খুব তথ্যসমৃদ্ধ হলেও বৃহত্তর চিত্রটা তিনি তুলে ধরতে পারতেন না। রোনাল্ড রিগ্যান ছিলেন এর বিপরীত। জনগণ সম্পৃক্ত গল্প বলার ধরনটা তার ভালো ছিলো, তবে সংক্ষিপ্ত।

তিনি বলেন, দু’জনই তাঁদের নিজ নিজ সক্ষমতা ও দুর্বলতাগুলো নিয়েই সরকার পরিচালনা করে গেছেন।

বিতর্কে স্মরণীয় উক্তি করার ক্ষেত্রে রিগ্যান ছিলেন তুখোড়। যে প্রশ্নটি করার মাধ্যমে তিনি নির্বাচনে জিতেছিলেন সেটা হলো, “চার বছর আগের চেয়ে আপনি এখন কি ভালো আছেন?”

অধিকাংশ সংবাদে এ ধরনের সংক্ষিপ্ত উক্তিগুলো প্রাধান্য পেলেও পুরো বক্তব্য শোনার মাধ্যমে ভোটাররা অনেক কিছু জানতে পারে। বেনোইট বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বিতর্ক দেখেন তাঁরা বিতর্ক দেখার পর এবং যারা বিতর্ক দেখেননি তাদের চেয়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বেশি জানেন।