পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বাড়িতে থাকতে চান?

ভাবুনতো কেমন হতো, যদি বাড়ি তৈরি করতে কম খরচ পড়তো, সেটি প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ নিজেই উৎপাদন করতে পারতো আর তা তৈরি করতে পরিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাবও না পড়তো?

১৯৬৯ সালে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক পাশ করার পর মাইকেল রেনল্ডস এ প্রশ্নের জবাব খোঁজাকেই তাঁর জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেন। স্থির করেন প্রমাণ করবেন, একজনের কাছে যেটা আবর্জনা সেটাই আরেকজনের জন্য হতে পারে সম্পদ।

রেনল্ডস বলেন, ‘আমি বিশাল কোনো ব্যবসা করতে চাইনি। শুধু চেয়েছিলাম আমার নিজের আর এলাকার বন্ধুদের জন্য কিছু করতে।’

মাইকেল রেনল্ডস গত ৫০ বছর ধরে আর্থশিপের নকশা ও তা তৈরি করছেন। এই আর্থশিপ হলো স্বয়ংসম্পূর্ণ বাড়ি। রেনল্ডস এগুলোর নাম দিয়েছেন ‘জাহাজ’। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের টাওস এলাকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই আর্থশিপ তৈরি করছেন।

প্রতিটি বাড়ি খাবার, পানি, বিদ্যুৎ জোগান দেয়। এসব বাড়িতে রয়েছে আরামদায়ক থাকার জায়গা, বর্জ্য পানি শোধনাগার ও আবর্জনা পুনর্ব্যবহারের সুবিধা। রেনল্ডস নিশ্চিত করেছেন যে, শীতের সময় বাড়িগুলো গরম রাখার জন্য তেল বা গ্যাসের মতো কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হবে না। তার মানে হলো, শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসব বাড়ি থেকে কোন কার্বনও নিঃসৃত হবে না।

হাতুড়ি হাতে মাথায় হ্যাট পড়া মাইকেল রেনল্ডস (পাবলো পরসিউনকুলা/এএফপি/গেটি ইমেজেস)
মাইকেল রেনল্ডস ২০১৬ সালে উরুগুয়ের মন্টিভিডিওর কাছে একটি স্বংয়ক্রিয়-টেকসই স্কুল নির্মাণে সহায়তা করছেন। তিনি আর্থশিপ নকশায় আবাসন তৈরির মূল উদ্দেশ্য, নির্মাণ কৌশল এবং এর পেছনের ভাবনা বিষয়ে ৩০টি দেশের ১০০ শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেন। সবাই মিলে বিশ্বে এ ধরনের প্রথম স্কুলটি নির্মাণ করেন তারা (**পাবলো পরসিউনকুলা/এএফপি/গেটি ইমেজেস)

রেনল্ডসের স্বপ্নের ফসল হলো নিউ মেক্সিকোর টাওস এলাকায় গড়ে ওঠা ‘টেকসই ও স্বয়ংসম্পূর্ণ’ এ ধরনের শতাধিক কাঠামো। তাঁর এ উদ্যোগ গত এক দশকে ডালাপালা মেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এবং দেশটির বাইরেও এমন শত শত কাঠামো নির্মিত হয়েছে। কানাডা থেকে আফ্রিকার মালাবি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে রেনল্ডসের এই উদ্যোগ।

রেনল্ডস প্রথম ‘আর্থশিপ’ তৈরির ধারণা পান ১৯৭০ সালে। টিভিতে সন্ধ্যার বুলেটিন দেখার সময়। টিভির একটি প্রতিবেদনে প্যাসিফিক নর্থওয়েস্টে কাঠের ঘাটতির বিষয়টি তুলে ধরা হচ্ছিল। আরেকটি সংবাদে বলা হলো বিয়ারের বিপুল পরিমাণ খালি ক্যানের সমস্যার কথা। রেনল্ডসের তখন মনে প্রশ্ন জাগে এমন কিছু করা যায় কিনা যাতে উভয় সমস্যার সমাধান মেলে!

রেনল্ডস বলেন, ‘আর্থশিপের পুরো ধারণাটা আমার কাছে এসেছে গণমাধ্যম থেকে। গণমাধ্যম আমাদের এই গ্রহে বিরাজমান সমস্যাগুলো তুলে ধরছিল। সে থেকেই আমার মাথায় আসে বুদ্ধিটা।’

ক্যান এবং বোতল দিয়ে তৈরি বাড়ির ধূসর দেয়ালঅলা অভ্যন্তর (© র‌্যামজে দ্য গিভ/দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট/ গেটি ইমেজেস)
একটি আর্থশিপের ভেতরের ছবি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের টাওস এলাকার ২০২১ সালের ডিসেম্বরের ছবি। ((© র‌্যামজে দ্য গিভ/দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট/ গেটি ইমেজেস)

রেনল্ডস তার প্রথম বাড়িটি তৈরি করেন বিল্ডিং ব্লকের মধ্যে বিয়ার ক্যানগুলো ইনসুলেশন হিসেবে ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিটি পরে নিজের নামে পেটেন্ট করেন তিনি। রেনল্ডস বলেন, বিয়ার কোম্পানিগুলো খালি ক্যান দিয়ে বাড়ি বানানোর কথা জানার পর পুরো নির্মাণ প্রকল্পেরই তহবিল জোগান দেয়।

রেনল্ডস দ্রুতই ঠিক করলেন, তিনি এমন আরও অনেক বাড়ি তৈরি করবেন যাতে বাসিন্দারা বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু পাবে। যেমন: খাবার, পানি, থাকার জায়গা এবং বর্জ্য পানি শোধনের ব্যবস্থা। একইসঙ্গে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাবও কমাবে তা।

প্রতিটি আর্থশিপের প্রায় ৪০ শতাংশ তৈরি করা হয়েছে প্রাকৃতিক বা পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি বস্তু ব্যবহার করে। প্রতিটি বাড়িই এর বাসিন্দাদের প্রয়োজনের ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ খাবার উৎপাদনে সক্ষম, যদি বাড়ির মালিক একটি বাগান করেন।

আংশিকভাবে শুষ্ক বাদামি ঘাসে আচ্ছাদিত পাহাড়ের ভেতরে নির্মিত, ধূসর ভবন। এর সিঁড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে পুরানো টায়ার দিয়ে। (শাটারস্টক.কম)
২০১৯ সালের অক্টোবরে নিউ মেক্সিকোর টাওসের স্টারশিপ কমিউনিটির একটি ভবন (শাটারস্টক.কম)

আর্থশিপে ‘আর্থ বার্মিং’ (বাড়ি গরমের সময় ঠান্ডা ও শীতে গরম রাখার বিশেষ নির্মাণ কৌশল) করে থাকার জায়গা আরামদায়ক করা হয়। এতে ব্যবহৃত হয় ভেতরে ফেলে দেওয়া টায়ার ও কাঁচের বোতল ভরা পুরু স্ল্যাব। সাধারণ একটি ১৪০ বর্গমিটার আর্থশিপের জন্য দেওয়ালের ভেতরে এক হাজার টায়ার ও পাঁচ শ’ কাঁচের বোতল রাখার প্রয়োজন হয়।

আর্থশিপে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়। সব ধরনের কাজে ব্যবহারের জন্য বৃষ্টির পানি ধরা, মজুত, পুনর্ব্যবহার ও শোধন করার জন্য ব্যবহার করা হয় বড় বড় পিপা (ব্যারেল)। এছাড়া ময়লা পানি (শৌচাগার বাদে গোসল ও সিংকসহ সব ব্যবহৃত পানি) জমিয়ে ঘর ও বাইরের বাগানে লাগানো গাছে দেওয়া হয়।

রেনল্ডস বলেন, ‘আমাদের দ্রুত নতুন নতুন উদ্ভাবনের দিকে যেতে হবে। এবং এটা সম্ভব। আমাদের হাতে সেই কৌশল রয়েছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের অন্য অনেক স্থপতি ও নকশাবিদেরা রেনল্ডসের পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন। বাড়ি তৈরিতে তারাও পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি বস্তু ব্যবহার করছেন। উদাহরণ হিসেবে দুটি বাড়ির কথা উল্লেখ করা যায়, একটি কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের ওয়ান্ডার হউস অন্যটি টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের কর্ক হাউস

পুরো বাড়ি পুনর্ব্যবহার করা বস্তু দিয়ে তৈরি করা সম্ভব না হলে রেনল্ডসের পরামর্শ হলো, বিদ্যমান বাড়িগুলোকে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব করা। যেমন, সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা ও পানি সংরক্ষণের ওপর জোর দেওয়া।

রেনল্ডস বলেন, ‘সূর্য আমার বাড়িতে আলো দেয়, তার মানে আমি বিদ্যুৎ পেতে পারি। আমার বাড়ির ওপর বৃষ্টি পড়ে, তার মানে আমি সহজে পানিও পেতে পারি। টেকসই ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার পথটা সহজ করা প্রয়োজন আমাদের।’